©ক্রাইম টিভি বাংলা অনলাইন ডেস্ক♦
দিনাজপুরে বিবাহ বিচ্ছেদ (তালাক) হচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। আর বিবাহ বিচ্ছেদের এই ঝুঁকি নিচ্ছেন শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী নারীরাই বেশি। এ-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান তা-ই বলছে।
স্কুল জীবনে সহপাঠী ছিলেন বিবেক ও উপাধী (ছদ্মনাম)। পাশাপাশি মহল্লার বাবিন্দা হওয়ায় এবং একই কলেজে পড়ার সুবাদে এইচএসসিতে পড়া অবস্থায় তাদের মধ্যে গড়ে উঠে প্রেমের সম্পর্ক। স্বপ্ন ছিল বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ভালো সরকারি চাকরি পেয়ে ঘর বাধবেন। কিন্তু ধৈর্য তাদেরকে ততদিন অপেক্ষা করতে দেয়নি। অনার্স প্রথম বর্ষে উপাধীর চাপা-চাপিতেই পরিবারের অজান্তে বিয়ে করতে বাধ্য হন বিবেক। এক পর্যায়ে বিষয়টি জেনে যায় তাদের পরিবার।
এ অবস্থায় চলতে থাকে তাদের অনার্স-মাস্টার্সের পড়াশোনা। লেখাপড়া শেষে বিসিএসে উপাধীর ভাগ্য খুললেও বিবেকের ভাগ্য খোলেনি। তারপরও দুঃসময়ে সঙ্গী ও নিজের সংসারের ভার একাই সামলে নেন উপাধী। এরপর বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরি নেন বিবেক। কিন্তু একযুগ পর ভাগ্য পোড়ে বিবেকের। তার সঙ্গে আর সংসার করতে চান না উপাধী। হঠাৎ উপাধীর ডাকযোগে পাঠানো তালাকনামায় ভাঙে ভালোবাসার সংসার।
শুধু উপাধী আর বিবেক নয়, এমন ভালোবাসার সংসার প্রতিনিয়ত ভেঙে যাচ্ছে। ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আগের চেয়ে কর্মক্ষেত্রে নারীদের কাজ করার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় নারীরা সামাজিকতা ও লোকলজ্জার চেয়ে নিজের আত্মসম্মানকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া, স্টার জলসা, স্টার প্লাসসহ ভারতীয় সিরিয়াল (এগুলোতে সংসারের ভাঙন দেখানো হয় বেশি), মাদকাসক্ত, ইন্টানেটের ব্যবহার, সর্বোপরি যৌতুক নামের ভিক্ষাবৃক্তির কুফল এতে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সংসারে অশান্তি নিয়ে থাকার পরিবর্তে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তই বেশি নিচ্ছেন মেয়েরা।
জানা গেছে, দিনাজপুরে সাম্প্রতিক সময় বিবাহ বিচ্ছেদের হার আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এক্ষেত্রে বিচ্ছেদের বেশি আবেদন করছেন শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী নারীরা।
দিনাজপুর পৌরসভার তালাক সংক্রান্ত সালিশি পরিষদ সূত্রে জানা যায়, নারীরাই বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য পুরুষদের চেয়ে বেশি আবেদন করছেন।
স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক দেয়ার বিষয়ে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ (১) ধারায় বলা হয়ে, কোনো ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চান, তিনি যেকোনো পদ্ধতিতে তালাক ঘোষণার পর যথা শিগগির সম্ভব চেয়ারম্যানকে (স্থানীয় ইউনিয়ন/পৌর চেয়ারম্যান/প্রশাসক) লিখিতভাবে নোটিশ দেবেন এবং স্ত্রীকে উক্ত নোটিশের একটি অনুলিপি (নকল) প্রদান করবেন।
৭ (৪) ধারা অনুযায়ী, নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে পুনর্মিলন ঘটানোর উদ্দেশ্যে একটি সালিশি পরিষদ গঠন করবেন এবং উক্ত সালিশি পরিষদ এই জাতীয় পুনর্মিলনের জন্য প্রয়োজনীয় সবধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
৭ (৩) ধারা অনুযায়ী, চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ প্রদানের তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কার্যকর হবে না। কিন্তু, তালাক ঘোষণার সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী থাকেন, তাহলে ৭(৫) ধারা অনুযায়ী গর্ভাবস্থা অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না।
তালাকের নোটিশ যে পক্ষ থেকেই দেয়া হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান বা মেয়র নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষের মনোনীত প্রতিনিধিকে নিয়ে বসবেন। উভয় পক্ষকে লিখিত নোটিশ পাঠিয়ে সমঝোতার চেষ্টা করবেন।
দিনাজপুর পৌরসভার সভা সূত্রে জানা যায়, সেই নিয়ম অনুযায়ী দিনাজপুর পৌরসভার তালাক সংক্রান্ত সালিশি পরিষদে সালিশ চলাকালে প্রতিনিয়ত ১৫-২০টি তালাক সংক্রান্ত নথি উপস্থাপন করা হয়। যার মধ্যে প্রতিদিনই কোনো না কোনো তালাক চূড়ান্ত হয়। সংসার টিকানোর জন্য বিভিন্ন কৌশলে নতুন করে তারিখ দেয়া হয়। গত এক সপ্তাহে যে তালাকগুলো হয়েছে, এর মধ্যে ১১টি তালাক দিয়েছে নারী ও ৭টি তালাক দিয়েছে পুরুষ।
আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে দিনাজপুর পৌরসভার তালাক সংক্রান্ত সালিশি পরিষদে সালিশের জন্য নতুন ১৭টি নথি উপস্থাপন করা হবে। যার মধ্যে ১৫টি তালাক নারী ও ২টি পুরুষ দিয়েছে।
এ বিষয়ে কথা হয় দিনাজপুর পৌরসভার তালাক সংক্রান্ত সালিশি পরিষদের প্রধান কাউন্সিলর আবু তৈয়ব আলী দুলালের সঙ্গে। তিনি জানান, নারীদের তালাক দেয়ার হার পুরুষের চেয়ে বহুগুণ বেশি। পেশাগত উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা আগের চেয়ে বেশি সচেতন। নারীরা লোকলজ্জার ভয়ে এখন আর আপস করছেন না। বরং অশান্তি এড়াতে বিচ্ছেদের আবেদন করছেন।
জেলা রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা যায়, দিনাজপুর জেলায় ২০১৯ সালে বিয়ে হয়েছে ১৫ হাজার ৬৮৮ টি, আর তালাক হয়েছে ৫ হাজার ৬৭৬টি। যা শতকরা ৩৬ শতাংশ প্রায়। ২০১৮ সালে বিয়ে হয়েছে ১৫ হাজার ৫৫৯টি, আর তালাক হয়েছে ৫ হাজার ২০৮টি। শতকরা হিসাবে ৩৩ শতাংশ প্রায় এবং ২০১৭ সালে বিয়ে হয়েছে ১৪ হাজার ২৬৪টি, তালাক হয়েছে ৫ হাজার ৩৪৫টি, যা শতকরা হিসাবে ৩৭ দশমিক ৪৭ ভাগ। সরকারের রাজন্ব আদায় হয়েছে ৬ লাখের বেশি।
দিনাজপুর জেলার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) মিন্টু কুমার পাল বলেন, সামাজিক জটিলতার জন্য সমাজে বিচ্ছেদের ঘটনা এক দশকে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সন্তানের মঙ্গল, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ রোধে বিচ্ছেদে যাওয়ার ক্ষেত্রে দোষের কিছু নেই।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকায় একজন নারী এখন তার পরিবারকেও আর্থিক সহায়তা করতে পারছে। পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে অনেক নারী নিজের পেশা জীবনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। আর মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ফলে নারী নিজেই এখন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
একমাত্র ধর্মীয় অনুশাসন ও মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।