©ক্রাইম টিভি বাংলা অনলাইন ডেস্ক♦
আর্জেন্টিনা শব্দটি শুনতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীল আর সাদার মিশ্রণে অপূর্ব সুন্দর এক পতাকার রঙ। ভেসে ওঠে নান্দনিক ফুটবল। ফুটবলের অন্যতম কিংবদন্তি ম্যারাডোনা অথবা আজকের সেরা খেলোয়াড় মেসির মুখ আর পায়ের কারুকাজও আমাদের চোখ রাঙিয়ে দেয়। অথচ এই আর্জেন্টিনা ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক দেশ। জানতে হলে পুরোটা বা অনেকটাই জেনে রাখা ভালো।
আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকার একটি রাষ্ট্র। দেশটির বৃহত্তম শহর ও রাজধানী বুয়েনোস আইরেস । দেশটি দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ অংশের প্রায় পুরোটা জুড়ে অবস্থিত। আয়তনের দিক থেকে এটি দক্ষিণ আমেরিকার ২য় বৃহত্তম এবং বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম রাষ্ট্র। আর্জেন্টিনায় ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ু বিচিত্র। উত্তরের নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে দক্ষিণের মেরু-উপদেশীয় অঞ্চল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার বিস্তার। এর মধ্যেই আছে রুক্ষ আন্দেস পর্বতমালা ও তাঁর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আকোনকাগুয়া। তবে বেশির ভাগ লোক দেশটির মধ্যভাগে অবস্থিত বিশাল উর্বর প্রেইরি সমভূমির (যার নাম পাম্পাস) শহরগুলিতে বাস করেন। পাম্পাসেই দেশটির অধিকাংশ কৃষিসম্পদ উৎপন্ন হয় এবং এখানেই দক্ষিণ আমেরিকার বিখ্যাত কাউবয় “গাউচো”-দের আবাসস্থল।
আর্জেন্টিনাতে আদি প্রস্তর যুগে মানব বসতির নিদর্শন পাওয়া গেছে। আধুনিক আর্জেন্টিনার ইতিহাস ১৬শ শতকে স্পেনীয় উপনিবেশীকরণের মাধ্যমে সূচিত হয়। ১৭৭৬ সালে এখানে স্পেনীয় সাম্রাজ্যের অধীনে রিও দে লা প্লাতা উপরাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এই উপরাজ্যের উত্তরসূরী রাষ্ট্র হিসেবে আর্জেন্টিনার উত্থান ঘটে। ১৮১০ সালে আর্জেন্টিনা স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৮১৮ সালে স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধবিজয় শেষ হয়। এরপরে দেশটিতে অনেকগুলি গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৬১ সালে অনেকগুলি অঙ্গরাজ্যের একটি ফেডারেশন হিসেবে দেশটি পুনর্গঠিত হয়। যার রাজধানী নির্ধারিত হয় বুয়েনোস আইরেস। এর পরে দেশটিতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফেরত আসে এবং ইউরোপ থেকে বিপুলসংখক অভিবাসীর আগমন ঘটে, যার ফলে সাংস্কৃতিক ও জনসংখ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে দেশটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ১৯শ শতকের শেষ ভাগ থেকে আর্জেন্টিনা প্রচুর পরিমাণে কৃষিদ্রব্য যেমন মাংস, পশম, গম, ইত্যাদি রপ্তানি করা শুরু করে। দক্ষিণ আমেরিকায় আর্জেন্টিনাতেই প্রথম শিল্পায়ন শুরু হয় এবং এটি বহুদিন ধরে এই মহাদেশের সবচেয়ে ধনী দেশ ছিল। সে সময় এখানকার অধিবাসীরা ইউরোপীয় দেশগুলির সমমানের জীবনযাত্রা নির্বাহ করত। ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করে দেশটি বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বের ৭ম ধনী দেশে পরিণত হয়। তবে ১৯৪০-এর দশকের পর থেকে আর্জেন্টিনা ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ বেকারত্ব ও বড় আকারের জাতীয় ঋণের সমস্যায় জর্জরিত।
আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক ইতিহাস সংঘাতময়। দেশটির সবচেয়ে বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট হুয়ান পেরন শ্রমিক শ্রেণী ও দরিদ্রদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন একজন একনায়ক এবং সমস্ত বিরোধিতা কঠোর হাতে দমন করতেন। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ১৯৫৫ সালে পেরনের পতন ঘটে। ১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত কুখ্যাত সামরিক শাসনের সময় বহু আর্জেন্টিনীয়কে বিচার ছাড়াই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ১৯৮৩ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছেড়ে দেবার পর আর্জেন্টিনায় আবার গণতন্ত্র স্থাপিত হয় কিন্তু দেশটি অর্থনৈতিক সমস্যায় তখনও হাবুডুবু খেতে থাকে। ২১শ শতকের প্রথম দশকেও আর্জেন্টিনা তার অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আর্জেন্টিনার আয়তন ২৭,৮০,৪০০ কিমি । দেশটি দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দক্ষিণাংশের প্রায় পুরোটা জুড়ে অবস্থিত। আন্দেস পর্বতমালা দেশটির পশ্চিম সীমানা নির্ধারণ করেছে, যার অপর পার্শ্বে চিলি অবস্থিত। দেশটি উত্তরে বলিভিয়া ও প্যারাগুয়ে, উত্তর-পূর্বে ব্রাজিল, পূর্বে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর।এবং দক্ষিণে ড্রেক প্রণালী। সব মিলিয়ে দেশটির স্থলসীমান্তের দৈর্ঘ্য ৯,৩৭৬ কিমি ।
মেন্দোসা প্রদেশে অবস্থিত আকোনকাগুয়া আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ পর্বত। এটি সমুদ্রতল থেকে ২২,৮৩১ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত।এছাড়াও আকোনকাগুয়া দক্ষিণ গোলার্ধ ও পশ্চিম গোলার্ধের সর্বোচ্চ পর্বত। আর্জেন্টিনার সর্বনিম্ন বিন্দু হচ্ছে সান্তা ক্রুস প্রদেশে অবস্থিত লাগুনা দেল কার্বন, যা সান হুলিয়ান বৃহত্ অবনমনের একটি । আর্জেন্টিনার উত্তরতম বিন্দুটি রিও গ্রান্দে দে সান হুয়ান ও রিও মোহিনেতে নদী দুটির সঙ্গমস্থলে, হুহুই প্রদেশে অবস্থিত। দেশটির দক্ষিণতম বিন্দু হল তিয়ের্রা দেল ফুয়েগো প্রদেশের সান পিও অন্তরীপ।
আর্জেন্টিনার প্রধান প্রধান নদীর মধ্যে রয়েছে পারানা নদী ও উরুগুয়াই নদী (নদী দুটি একত্র হয়ে রিও দে লা প্লাতা নদী গঠন করেছে), সালাদো নদী, রিও নেগ্রো নদী, সান্তা ক্রুস নদী, পিকোমাইয়ো নদী, বের্মেহো নদী ও কোলোরাদো নদী। এই সব নদীর পানি আর্জেন্টিনীয় সাগরে গিয়ে পড়েছে। আটলান্টিক সাগরের যে অগভীর অংশটি আর্জেন্টিনীয় শেলফ বা সমুদ্র-তাকের উপরে অবস্থিত, তাকেই আর্জেন্টিনীয় সাগর নামে ডাকা হয়। এটি একটি অস্বাভাবিকভাবে প্রশস্ত মহাদেশীয় মঞ্চ। এই সাগরের পানি দুইটি প্রধান মহাসাগরীয় স্রোতের প্রভাবাধীন: উষ্ণ ব্রাজিল স্রোত এবং শীতল ফকল্যান্ডস স্রোত। দক্ষিণে অবস্থিত ইসলা গ্রান্দে দে তিয়েররা দেল ফুয়েগো নামক দ্বীপের পূর্ব অর্ধাংশ আর্জেন্টিনার অন্তর্গত। এছাড়াও পূর্বের বেশ কিছু সামুদ্রিক দ্বীপ যেমন ইসলা দে লোস এস্তাদোস আর্জেন্টিনার অধীন।
বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম প্রতিনিধি আর্জেন্টিনা ফুটবল দল। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দুইবার এবং ফাইনালে খেলেছে চারবার।ফুটবল ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় উঠে এসেছেন আর্জেন্টিনা থেকেই।
ছবি ও তথ্য – ইন্টারনেট