©ক্রাইম টিভি বাংলা দক্ষিণ আমেরিকা ডেস্ক♦
ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও বলিভিয়া পরিবেষ্টিত দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যাঞ্চলের একটি অনুন্নত ভূখণ্ড প্যারাগুয়ে। লাতিন আমেরিকার ঠিক মধ্যভাগে অবস্থানের কারণে একে ‘হার্ট অব সাউথ আমেরিকা’ও বলা হয়। আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে প্যারাগুয়েই সবচেয়ে ছোট ভূমিবেষ্টিত দেশ। বাংলাদেশের মতো প্যারাগুয়েও একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। টাকা দিলে বাঘের চোখও মেলে – এই ফর্মূলায় সবই হয় সবই পাওয়া যায় তথা করা যায় সবকিছু প্যারাগুয়েতে। ৫-১০ ডলার সমপরিমাণ অর্থও যত্রতত্র ঘুষ খেয়ে অভ্যস্ত স্থানীয় পুলিশ।তবুও নানান কারণেই এই দেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মানচিত্র বিভাগের আজকের আয়োজন ‘প্যারাগুয়ে’।
ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেন উপনিবেশ স্থাপনের আগ পর্যন্ত প্যারাগুয়েতে গুয়ারানি আদিবাসীদের বাস ছিল। দেশটি স্বাধীন হয় ১৮১১ সালে। এর পরও দীর্ঘদিন ধারাবাহিকভাবে স্বৈরশাসন চলতে থাকে। ‘একলা চলো’ নীতি অনুসরণ করে তারা রক্ষণশীলভাবে দেশ পরিচালনা করে। ১৮৬৪-৭০ সাল পর্যন্ত নানামুখী যুদ্ধের কবলে পড়ে দেশটি। এই যুদ্ধে দেশটির বহু মানুষ প্রাণ হারায়। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের কাছে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমিও হারায় দেশটি। ১৯৯৩ সালে দেশটিতে প্রথমবারের মতো বহু দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়। পারাগুয়াই নদীটি প্যারাগুয়ে রাষ্ট্রের মাঝ বরাবর উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে এবং দেশটিকে পূর্ব-পশ্চিমে দুইভাগে ভাগ করেছে। প্যারাগুয়ের বেশির ভাগ জনগণ দেশটির পূর্বভাগে, অর্থাৎ পারাগুয়াই নদীর কাছে অবস্থিত উর্বর সমভূমিগুলিতে অথবা এগুলির পূর্বে ব্রাজিল সীমান্তের কাছে অবস্থিত জঙ্গলাকীর্ণ একটি মালভূমিতে বসবাস করে; এই অঞ্চলটির নাম পারানেনা। নদীর পশ্চিম দিকে গ্রান চাকো নামের একটি বৃহৎ, শুষ্ক সমভূমি অবস্থিত, যা প্যারাগুয়ের মোট ভূখণ্ডের ৬০%-এরও বেশি গঠন করেছে। নদীর কাছাকাছি জায়গাগুলিতে গ্রান চাকো জলাভূমিময়, তবে ক্রমে পশ্চিমদিকে অগ্রসর হলে এটিতে ঝোপঝাড়-গুল্ম ও অরণ্যের দেখা মেলে। এই জনহীন প্রান্তরে বহু বিচিত্র প্রাণীর বাস; ফলে পশুপ্রেমী ও পাখীপ্রেমীরা প্রায়ই এখানে ঘুরতে আসেন। প্যারাগুয়ের জলবায়ু ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় ধরনের; তবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর দেখা মেলে। পারানেনা অঞ্চলটি আর্দ্র এবং এখানে সারাবছর ধরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে চাকো অঞ্চলটিতে পৃথক পৃথক শুষ্ক ও আর্দ্র মৌসুম স্পষ্ট। পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা না থাকায় চাকো অঞ্চলে প্রায়ই বন্যা হয়।
প্যারাগুয়ের বেশিরভাগ ভাগ লোক ক্ষেতখামার ও কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। দেশের পূর্ব সীমান্তের কাছের উর্বর অঞ্চলে আধুনিক বৈচিত্র্যায়িত কৃষি উৎপাদনের ফলে তুলনামূলকভাবে উচ্চমানের জীবন ধারণ করা সম্ভব। প্যারাগুয়ের কৃষকেরা অতীতে ছোট আয়তনের খামারে একটিমাত্র শস্য ফলাতেন। বর্তমানে সমগ্র দেশজুড়ে সমবায় খামারের সৃষ্টি হয়েছে এবং এতে কৃষকদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটেছে।বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম সয়াবিন উৎপাদনকারী দেশ প্যারাগুয়ে। এ ছাড়া নানা জাতের তেল উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত দেশটি।
বাংলাদেশের মতো প্যারাগুয়েও একটি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। টাকা দিলে বাঘের চোখও মেলে – এই ফর্মূলায় সবই হয় সবই পাওয়া যায় তথা করা যায় সবকিছু প্যারাগুয়েতে। আগেই উল্লেখ করেছি, ৫-১০ ডলার সমপরিমাণ অর্থও যত্রতত্র ঘুষ খেয়ে অভ্যস্ত স্থানীয় পুলিশ। গাঁজা চাষের জন্য প্যারাগুয়ের খ্যাতি আছে লাতিন আমেরিকায়, যার বেশির ভাগ চালান হয় প্রতিবেশী ব্রাজিলে। হিউম্যান ট্র্যাফিকিংও জমজমাট। আদম ব্যবসায় বাংলাদেশিদের মধ্য থেকেও বেশ ক’জন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন যথারীতি। অভিবাসী হিসেবে কোন রকমে দেশটিতে ঢুকতে পারলে ওয়ান-টু’র মধ্যে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করে বৈধ হওয়া যায় এখানে। হাজার-পনেরশ’ ডলার খরচায় চুক্তিভিত্তিক বিবাহের জন্য মেয়ে পাওয়া পানির মতো সহজ প্যারাগুয়েতে। কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ ছাড়াও ভিন্ন পথে বছরের যেকোনো সময় লিগ্যালিটি পাওয়া যায়, এক্ষেত্রে খরচ পড়ে ৮শ’ থেকে ১২শ’ ডলার। সর্বোচ্চ দুই হাজার ডলার পেমেন্ট করারও নজির আছে, তবে সবকিছুই নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর।
পুরো প্যারাগুয়েতে বর্তমানে প্রায় শ’খানেক বাংলাদেশি পরিবারের বসবাস। কোথাও কোনো সভা সমিতি সংগঠন তেমন প্রতিষ্ঠিত না হলেও বাংলাদেশি অধ্যুষিত প্রধান শহর ‘সিউদাদ দেল এস্তে’, যেখানে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ মিনার শোভিত সুপরিসর মসজিদ। ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশিদের অর্থায়নে কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদের প্রবেশমুখের শোভা বর্ধন করেছে বাংলাদেশ-প্যারাগুয়ে সৌহার্দের প্রতীক দু’দেশের জাতীয় পতাকা। বিদেশ বিভুঁইয়ে দেশের কৃষ্টি সংস্কৃতিকে ভুলে যাননি এমন উদ্যমী বাংলাদেশিরা এখানে ঘটা করে উদযাপন করতে শুরু করেছেন বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবস, নাটকও মঞ্চায়ণ করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তারা প্যারাগুয়ের মাটিতে। প্রতিবেশী ব্রাজিলের মতো বিগ ভলিউমে না হলেও বাংলাদেশি গার্মেন্টস সামগ্রী চিলি হয়ে সীমিত পরিসরে আসছে এদেশে।
প্যারাগুয়ে অপূর্ব সুন্দর এক দেশ। দেখার মতো দৃষ্টিনন্দন জায়গা প্রচুর। কই ও চরুরি পাহাড়, মান ডে জলপ্রপাত, নাকুন্ডে জলপ্রপাত, ভাল্লেমি ক্যাভারন্স, সমুদ্রের চোখ, ত্রি টানেল, ইয়া পাকারাই লেক ও অন্যান্য।
এক নজরে
পুরো নাম : প্যারাগুয়ে প্রজাতন্ত্র।
রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর : আসুনসিয়ন।
দাপ্তরিক ভাষা : স্প্যানিশ, গুয়ারানি।
জাতিগোষ্ঠী : ৯৫ শতাংশ মাস্তিজো ও অন্যান্য ৫ শতাংশ।
সরকার পদ্ধতি : ইউনিটারি প্রেসিডেনশিয়াল কনস্টিটিউশনাল রিপাবলিক।
আইনসভা : কংগ্রেস।
উচ্চকক্ষ : সিনেট।
নিম্নকক্ষ : চেম্বর অব ডেপুটিস।
স্পেন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা : ১৪ মে ১৮১১।
স্বীকৃতি : ২৫ নভেম্বর ১৮৪২।
আয়তন : চার লাখ ছয় হাজার ৭৫২ বর্গকিলোমিটার।
জনসংখ্যা : ৬৭ লাখ ২৫ হাজার ৩০৮।
ঘনত্ব : প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৭.২ জন।
জিডিপি : মোট ৬৮.০০৫ বিলিয়ন ডলার।
মাথাপিছু : ৯ হাজার ৭৭৯ ডলার।
মুদ্রা : গুয়ারানি।
জাতিসংঘে যোগদান : ২৪ অক্টোবর ১৯৪৫ সাল।
ছবি ও তথ্য – ইন্টারনেট