ভারতের গোশতে সর্বনাশ
১৫ মাসে এসেছে ৯২৬৬ টন মহিষের গোশত : বাংলাদেশে ঢুকলেই ‘গরু’! মেয়াদোত্তীর্ণ গোশতে জীবাণু ও বিষক্রিয়া হতে পারে : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আমদানির প্রয়োজনই নেই : মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী
©ক্রাইম টিভি বাংলা ডেস্ক♦
ভারত থেকে টনে টনে আসছে মহিষের গোশত। প্রায় নীরবে চলছে আমদানি ও বাজার দখল। হুমকির মুখে পড়েছে দেশের বিকাশমান প্রাণিসম্পদ খাত। গত ১৫ মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস হয়েছে ৩শ’ কোটি টাকার হিমায়িত মহিষের গোশত। নামেমাত্র শুল্ক। নেই মান যাচাই ছাড়পত্র। আমদানির নামে ভারতীয় গোশতের ডাম্পিং সর্বনাশ ডেকে আনছে দেশের লাখ লাখ ডেইরি মালিক, কৃষক-কিষাণী খামারি গৃহস্থের। প্রাণিসম্পদ সুরক্ষা ও উন্নয়নে সরকারের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে ভারতের গোশতপ্রেমী গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর স্বার্থে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারতে মহিষের গোশত কেজি মাত্র দেড়শ’ টাকা। তাই ডাম্পিং-এর মতলবে বাংলাদেশকে টার্গেট। দেশে ঢুকলেই ‘গরুর গোশত’ নামে চড়া দামে বিক্রি! আধা-পচাগলাও ডাম্পিং করা হচ্ছে। এই গোশতের মান নিয়ে অনেকেরই অনেক প্রশ্ন। আছে হারাম-হালালের প্রশ্নও। মান যাচাই, তদারকি নেই। সব মিলিয়ে স্বচ্ছতার অভাব। জনস্বাস্থ্যও চরম ঝুঁকিতে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ইনকিলাবকে বলেছেন, শুধু ভারত কেন কোন দেশ থেকে গোশত আমদানির প্রয়োজনই নেই। প্রাণিসম্পদে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। এ ব্যাপারে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, সব পক্ষের সাথে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ভারত গরু আসা বন্ধ করে দেয় কয়েক বছর আগে। হয় শাপে বর। প্রাণিসম্পদে আজ স্বনির্ভর বাংলাদেশ। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাবে, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়ার সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। এ মুহূর্তে দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি গবাদিপশু রয়েছে। প্রতিবছরই বাড়ছে। করোনা কালে গ্রামে-গঞ্জে গবাদিপশু পালনে আগ্রহ আরও বেড়েছে। পশুহাটে বিকিকিনি হয় প্রচুর মহিষ। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, ফরিদপুর, বগুড়া, সিলেট, কুমিল্লা ছাড়াও চর-উপকূল-দ্বীপাঞ্চল, হাওড়-বাওড়ে মহিষের বিশাল বিশাল পাল বা বাথান, মহিষের গাড়ি চোখে পড়ে। দেশবাসীর ঐতিহ্য ও রক্তের সঙ্গে মিশে আছে- ‘ওরে ও মইষাল ভাই’য়ের মতো হৃদয় নিংড়ানো লোকজ গান।
গরু-মহিষসহ প্রাণিসম্পদে প্রাচুর্যের ফলে তরল দুধ, দই-ঘি-মাখনসহ দুগ্ধজাত খাবার এবং গোশতের চাহিদার পুরোটাই স্থানীয়ভাবে পূরণ হচ্ছে। চাহিদাই নেই অথচ ভারত থেকে অবাধে আসছে মহিষের গোশত। আমদানি বিলাসিতায় বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ঘটছে। বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় প্রাণিসম্পদ খাতে দেশের ৮০ হাজার গ্রামের কৃষক-খামারির জীবনধারণ। সঙ্কটে পড়ছে গ্রামীণ অর্থনীতি।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের হিসেেব, চলতি বছরের পয়লা জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মহিষের গোশত আমদানি হয়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার ৩৩৪ কেজি। যার মূল্য ৬ কোটি ৭১ লাখ ৯৫ হাজার ৫৪০ টাকা। গত বছরের পয়লা জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আমদানি হয় ৯০ লাখ ৪২ হজার ৬৩২ কেজি। মোট ১৫ মাসে মহিষের গোশত আমদানি হয়েছে ৯ হাজার ২৬৬ মেট্রিক টন। মোট মূল্য ২৯৭ কোটি ৭১ লাখ ৩৩ হাজার ৬৮৪ টাকা। এতে রাজস্ব আয় হয়েছে ২০ কোটি ২১ লাখ ৬ হাজার ৯৬১ টাকা। ভারতের গোশত আমদানিতে শুল্ক মাত্র ৩৩ শতাংশ। তালিকাভুক্ত আমদানিকারকের সংখ্যা ৪৫।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. ফখরুল আলম বলেন, এক সময় প্রাণিসম্পদ বিভাগের ছাড়পত্র নিয়েই এসব গোশতের চালান আমদানি হতো। এখন আদালতের নির্দেশে আমদানিকারকরা চালান খালাস করে নিচ্ছেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রিয়াজুল হক বলেন, ভারত থেকে মহিষের গোশত আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তবে গত দেড় বছর আগে কোয়ারেন্টাইন সনদ দেওয়া শুরু হয়। আমদানিকৃত গোশতের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সনদ দেয়া হতো। তবে গত ছয় মাস ধরে এমন সনদ দেয়া বন্ধ আছে।
এই সুযোগে মহিষের পচা গোশতও আসছে। স¤প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে পচা গোশতভর্তি রীফার কন্টেইনার (ফ্রোজেন) থেকে উৎকট দুর্গন্ধ ও পরিবেশ দূষণের দায়ে আমদানিকারক ইগলু ফুড ও সিএন্ডএফ এজেন্ট কর্ণফুলী লিমিটেডকে লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এরআগে ৩০ জুন আমদানিকারকরা খালাস না করায় ১৭৪ টন গোশত নিলামে তোলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
ব্যবসায়ীরা জানান, আমদানিকৃত এই গোশত দেশের হোটেল রেস্তোঁরায় চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। কাস্টম হাউসের হিসাবে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা পর্যন্ত শুল্ক-কর পরিশোধের পর প্রতিকেজির দাম পড়ে ৩২১ টাকা। অথচ বাজারে ৫৫০ থেকে ৬শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হিমায়িত এই গোশত নরমাল করে কসাইয়ের দোকানেও বেচাকেনা হয়। অবিক্রিত গোশত আবার ফ্রিজে রাখা হয়। এতে গোশতের স্বাভাবিক রঙ এবং স্বাদ বিনষ্ট হয়ে যায়। এ গোশতের প্যাকেটে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, মূল্য, উৎপাদন ও মেয়াদের তারিখ থাকে না। প্রতিদিনই ঠকছেন ভোক্তারা।
অন্ত্র রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. শামীম বক্স বলেন, নরমাল করার পর ফের ফ্রিজে রাখা কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ গোশতে জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে। এসব গোশত খাওয়ার পর তাৎক্ষণিক খাদ্যে বিষক্রিয়া অথবা নানা জটিল রোগ হতে পারে। ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, মহিষের গোশতকে গরুর গোশত বলে বিক্রি ভোক্তাদের সাথে প্রতারণা। এটা বন্ধ করা উচিত। দেশে পর্যাপ্ত গবাদিপশু থাকার পরও গোশত আমদানি জাতীয় স্বার্থবিরোধী।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল শাহ এমরান বলেন, গোশতে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। এরপরও ভারত থেকে মহিষের গোশত আমদানির কারণে এ খাতে চরম বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে গরীবরা নিঃস্ব হবে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধস নামবে। পশুপালনের সঙ্গে দেশের দুই কোটি মানুষ নির্ভরশীল। এদের স্বার্থে অবিলম্বে আমদানি বন্ধ করতে হবে।
হালাল মিট ইম্পোটার্স অ্যাসেসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শামীম আহমেদ বলেন, আমরা বৈধ পথেই শুল্ক দিয়ে মহিষের গোশত আমদানি করছি। এসব গোশতের মান নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। দেশে মোট চাহিদার সামান্য অংশই আমদানি হচ্ছে। এতে গোশতের দাম স্থিতিশীল আছে, মানুষের আমিষের চাহিদাও পূরণ হচ্ছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, দেশ গোশতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গেল দুটি কোরবানির ঈদে ভারত, মিয়ানমার থেকে গবাদিপশু আনতে হয়নি। দেশের খামারি, কৃষক ও গৃহস্থদের লালিত-পালিত গবাদিপশুতেই চাহিদা পূরণ হয়েছে। ভারত থেকে মহিষের গোশতসহ কোন গোশতই আমদানির প্রয়োজন নেই। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে আমরা এ অভিমত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জানিয়ে দিয়েছি। বিদেশে অবস্থানরত বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী গোশত আমদানি বন্ধে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের চিঠি প্রসঙ্গে বলেন, দেশে ফিরেই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।